চট্টগ্রামের বয়স কত? একবাক্যে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কারণ দুটি: এক. চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য আছে এবং ‘নানা মুনির নানা মতে’র কারণে নানা বিপদ তৈরি হয়েছে বলে ইতিহাস তার অগ্রযাত্রায় একটি সমণ্বিত মোহনায় পৌঁছাতে পারেনি; এবং দুই. সত্যিকার অর্থে নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র দিয়ে চট্টগ্রামের অকাট্য ইতিহাস অদ্যাবধি রচিত হয়নি। ফলে ‘সস্তায় যা পাওয়া যায় তাই বস্তা’ ভরে নিয়ে যাওয়া আর কি! তাই চট্টগ্রামের বয়স কত তার উত্তরে প্রায়ই বলা হয়, ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’। বিশেষ করে চট্টগ্রামের একটি দৈনিকের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত একটি গ্রন্থের নাম ছিল ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’। তখন থেকেই মানুষের মুখস্থ বিদ্যা হচ্ছে, ‘চট্টগ্রামের বয়স এক হাজার বছর’। কিন্তু কীসের ওপর ভিত্তি করে, কোন তথ্য-প্রমাণ হাজির করে এবং কোন সূত্রমতে চট্টগ্রামের বয়স হাজার বছর তা প্রমাণিত সত্য হিসেবে কোনো পর্যায়ে এখানে হাজির করা হয়নি। ফলে ‘চট্টগ্রামের বয়স হাজার বছর’ বলে ক্রমবিস্তারমান জনশ্রুতি থাকলেও ‘চট্টগ্রামের বয়স কত’ তা নিয়ে কোনো গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে অদ্যাবধি পৌঁছানো যায়নি। এখানে চট্টগ্রামের বয়স কত তা নিয়ে আমার চলমান গবেষণার কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করছি। লেখা-বাহুল্য, এখানে যেসব আলোচনা উপস্থাপনা করছি, তার যথেষ্ট অথেনটিক সূত্র এখনো সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। তবে একটা বিষয় শুরুতেই নিশ্চিতভাবে বলে নেয়া যায় যে, চট্টগ্রামের বয়স এক হাজার বছরের নয়। বরং কয়েক হাজার বছরের একটি পুরনো নগর হচ্ছে চট্টগ্রাম।
২০১৭ সালের ৩০ মে প্রকাশিত লন্ডনের বিখ্যাত কাগজ দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম নগরীর নাম জেরিকো, যা প্যালেস্টাইনের টেরিটরিতে অবস্থিত ছিল। যার বয়স ধরা হয় প্রায় ১১ হাজার বছর, কারণ খ্রিস্টপূর্ব নয় হাজার বছর আগে এ নগর গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়। দ্বিতীয় প্রাচীন নগরী লেবাননের বিবলোস (৭ হাজার বছর পুরনো), তৃতীয় প্রাচীন নগরী সিরিয়ার আলেপ্পো (৬ হাজার ৩০০ বছর পুরনো), চতুর্থ প্রাচীন নগরী সিরিয়ার দামেস্ক (৬ হাজার ৩০০ বছর পুরনো), পঞ্চম প্রাচীন নগরী ইরানের সোসা (৬ হাজার ২০০ বছর পুরনো), ষষ্ঠ হচ্ছে মিসরের ফাইউম (৬ হাজার ২০০ বছর পুরনো), সপ্তম লেবাননের সিডম (৬ হাজার বছর পুরনো), অষ্টম বুলগেরিয়ার প্লাভদিভ (৬ হাজার বছর পুরনো), নবম তুরস্কের গাজিয়ানটেপ (৫ হাজার ৬৫০ বছর পুরনো) ও দশম লেবাননের বৈরুত (৫ হাজার বছর পুরনো)। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সে প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন নগরী হচ্ছে ভারতের বানারস, যা পৃথিবীর ২০তম প্রাচীন নগরী হিসেবে স্বীকৃতি এবং যার বয়স প্রায় তিন হাজার বছর। ২০১০ সালের জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রকাশিত পাকিস্তানের ডন প্রত্রিকা দাবি করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন নগর পাকিস্তানের পেশোয়ার; যার বয়স ধরা হয় ২ হাজার ৫৩৯ বছর। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, যদি চট্টগ্রামের ইতিহাস সঠিকভাবে গবেষণা করে বের করা সম্ভব হয়, তাহলে চট্টগ্রাম হবে পৃথিবীর প্রাচীন নগরীর মধ্যে দশম, এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার অবশ্যই প্রাচীনতম নগরী। কলকাতার বয়স প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আর ঢাকার বয়স প্রায় চারশ বছর। ফলে চট্টগ্রাম নিঃসন্দেহে হতে পারে বাংলাদেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম নগরী। কয়েকটি নমুনা দেয়া যাক।
ভারতীয় সভ্যতার অনেক আদি নেরেটিভ পাওয়া যায় ভারতীয় সভ্যতার অমূল্য স্বাক্ষর মহাভারত-এ। নানা শ্লোকের মাধ্যমে এর নানা কাহিনী, মিথ ও নেরেটিভ বর্ণিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, প্রথম দিকে মহাভারত-এর শ্লোক সংখ্যা ছিল আট-দশ হাজার; যা পরবর্তীতে চর্চিত এবং ব্যাখ্যাত হতে হতে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে লক্ষাধিক। মহাভারত-এর নানা শ্লোকে আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ও কাঞ্চননাথের উল্লেখ আছে জনবসতির নিদর্শনস্বরূপ; যা থেকে অনুমান করা যায় যে, মহাভারত-এর রচনাকালেও বর্তমান চট্টগ্রামের বিখ্যাত আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ও কাঞ্চননাথের অস্তিত্ব ছিল এবং সেখানে জনবসতির ছিল। মহাভারত রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান চট্টগ্রামের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। অর্থাত্ আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে একটি নগরী হিসেবে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছিল এবং সে বৃহত্তর চট্টগ্রামের অংশ হিসেবে আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ও কাঞ্চননাথে জনগণের বসতি ছিল। সুতরাং মহাভারত-এ উল্লিখিত সময়ের হিসাব বিবেচনায় নিলে চট্টগ্রামের অবস্থান পৃথিবী দশম প্রাচীনতম নগরী লেবাননের বৈরুত (৫ হাজার বছর পুরনো) আগে হওয়ার কথা। আর দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন নগরী হিসেবে দাবিকৃত বানারস ও পেশোয়ারের চেয়ে কয়েক হাজার বছর আগের নগরী হিসেবে নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম নগরী হচ্ছে চট্টগ্রাম।
আরো একটি নমুনা দেয়া যাক। এটা সবাই না হলেও অনেকেই জানেন যে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নব্যপ্রস্তর যুগের ভষ্মীভূত একটি অস্ত্র পাওয়া যায়। ফলে নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন যে, চট্টগ্রামের এ অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর যুগের সাংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা ছিল। নৃবিজ্ঞানী ও ভাষাতাত্ত্বিকরা আরো ধারণা করেন যে, সম্ভবত এ অঞ্চলের লোক অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর শাখা ছিল। নৃতাত্ত্বিক সময় গণনার হিসাব অনুযায়ীম নব্যপ্রস্তর যুগ ছিল খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে। যদি তাই হয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের অস্তিত্ব এবং এতদঞ্চলের মানুষের বসতির বয়স প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে। সে হিসাবে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর ১৩তম প্রাচীন নগরী ইরাকের আরবিল শহরের আগে চট্টগ্রামের অবস্থান হওয়া কথা। এবং খুবই স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রাম এশিয়ার ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম নগরী হওয়ার দাবি রাখে।
তবে একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ভূগোলবিদ টলেমি, প্লিনি এবং এক অজানা গ্রিক নাবিকের লেখা পেরিপ্লাস অব দি ইরিত্রিয়ান সি নামক গ্রন্থে যা লিখিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে। পেরিপ্লাস অব দি ইরিত্রিয়ান সি গ্রন্থে ত্রিস বলে একটি স্থানের কথা উল্লেখ করা আছে। ঐতিহাসিক ড. নলিনীকান্ত ভট্টাশালীর মতে, পেরিপ্লাস অব দি ইরিত্রিয়ান সি-এ যে ত্রিসের কথা বলা আছে, সেটা হচ্ছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ। যদি তাই হয়, তাহলে চট্টগ্রামের জনবসতির বয়স প্রায় দুই হাজার বছর।
প্রাচীন নগরী হিসেবে যদি চট্টগ্রামের বয়স মহাভারতের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে পাঁচ হাজার বছর হয় কিংবা নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কারের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার হাজার বছর হয় কিংবা পেরিপ্লাস অব দি ইরিত্রিয়ান সি গ্রন্থের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছরের অধিক হয়, তাহলে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-এর ধারণা কোনোভাবেই ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দাঁড় করানো যাবে না।
চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আরো একটি ধারণা জনপ্রিয় বয়ানে চট্টগ্রামে প্রচলিত আছে, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বদর শাহ (রা.), চেরাঙ্গি পাহাড়, চাটি জ্বালানোর পুরাণ। সংক্ষেপে পুরাণটা এ রকম যে, হযরত বদর শাহ (রা.) চট্টগ্রামে এসেছিলেন; কিন্তু ঘোর অন্ধকারে কোথায় যাবেন এবং কোথায় অবস্থান করবেন তা নিয়ে তিনি যখন চিন্তাভাবনা করছিলেন, তখন তিনি একটি চাটি (চেরাগ) জ্বালিয়ে একটি বিশেষ জায়গায় অবস্থান করে ‘অন্ধকার দূর’ করেছিলেন। তখন থেকেই সেই জায়গাটার নাম চেরাগির পাহাড়, যা এখন জামালখান রাস্তার মোড়ে অবস্থিত। এবং ধারণা করা হয়, সে ‘চাটি’ থেকে বর্তমান চাটিগাঁ বা চট্টগ্রাম নামের উত্পত্তি। যদি আমরা এ পুরাণটাকে একটি ইতিহাস হিসেবে ধরে নিই, তাহলে চট্টগ্রামের বয়স হচ্ছে মাত্র সাতশ বছর; হাজার বছর নয়। বদর শাহ’র চট্টগ্রামের আগমনের পুরাণ যা-ই হোক না কেন, ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (রা.) তার ৩৬০ জন অনুসারী নিয়ে ইয়েমেন থেকে দিল্লি ও ঢাকা হয়ে সিলেটে আসেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। তার অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে নিবেদিত এবং অন্যতম ছিলেন হযরত বদর শাহ (রা.)। হযরত শাহজালানের নির্দেশে হযরত বদর শাহ (রা.) ধর্ম প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে আসেন এবং ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। হাটহাজারীর বদরটিলা, চকরিয়ার বদরখালী, কক্সবাজার বদরমোকাম, আকিয়াবের বদর মোকাম প্রভৃতি বদর শাহ (রা.)-এর ইসলাম প্রচারের সাক্ষ্য বহন করে। তিনি বদর শাহ, বদর আউলিয়া, বদর পীর এবং বদর আলম— এ রকম বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। যদি এ ঘটনাকে চট্টগ্রামের ইতিহাসের গোড়াপত্তনের সূচনা হিসেবে নিই, তাহলে চট্টগ্রামের ইতিহাস সাতশ বছরের। কিন্তু বদর শাহর চট্টগ্রামে আগমনের আগেই যে এখানে একটা সমৃদ্ধ নগর এবং একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং চট্টগ্রামের ইতিহাস কোনোভাবেই সাতশ বছরের নয়। বরং কয়েক হাজার বছর আগেই এ অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল। এ বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা এবং ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যদি গভীর এবং অথেনটিক গবেষণা করা সম্ভব হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হবে চট্টগ্রাম। ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃবিজ্ঞানীদের ইতিহাসের এ সূত্র অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিতে হবে। ইতিহাসের সে ঐতিহাসিক আবিষ্কারের প্রতীক্ষায় থাকলাম।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments