চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পদে পদে হয়রানির অভিযোগ


ট্যাক্সের বদলে ঘুষ দিতে উৎসাহ দেয়া হয় যাত্রীদের : টিআইবি



চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পদে পদে যাত্রী হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে সনাক–টিআইবি। ‘যাত্রীদের ট্যাক্স না দিয়ে ঘুষ দিতে’ সংশ্লিষ্টরা উৎসাহ প্রদান করছেন বলেও সংস্থার এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুযায়ী এখানে সেবার মান বাড়েনি বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। গতকাল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এমন অভিযোগ করে সনাক–টিআইবি। এ বিমানবন্দরে প্রবেশ থেকে শুরু করে উড্ডয়ন পর্যন্ত যাত্রীর বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম নিয়ে সংস্থাটির একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনও এ সময় প্রকাশ করা হয়। গত ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত করা গবেষণা কার্যক্রমটি যাত্রী সাধারণ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক কর্মকর্তা, এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা, ট্রাভেল এজেন্সি,ব্যবসায়ীদের বক্তব্যসহ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সনাক সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বছরে এক মিলিয়ন যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করছে। অধিকাংশ যাত্রীই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে। তথ্য কেন্দ্রের অনুপস্থিতিতে প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, ফলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যাত্রীদের পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব লক্ষণীয়। তদারকি ব্যবস্থার ঘাটতি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার অভাবে যাত্রী হয়রানি এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। সাধারণ যাত্রীরাও তাদের ব্যাপারে বলতে চান না বিভিন্ন হয়রানির ভয়ে। এখানে যাত্রীদের ট্যাক্স না দিয়ে ঘুষ দেয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের সাথে জড়িত কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও ইমিগ্রেশন শাখা। এর পরেই আছে সিভিল এভিয়েশন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্যরা।

গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়নকারী টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাফর সাদেক চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।বিমানবন্দরটিতে চার ক্যাটাগরির ফ্লাইটে যাত্রী সেবার ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, টার্মিনালে প্রবেশের ক্ষেত্রে যাত্রীর সাথে কতজন দর্শনার্থী প্রবেশ করতে পারবে তার সংখ্যা উল্লেখ নেই। দর্শনার্থী প্রবেশ ফি’র নিয়ম না থাকায় আনসার ও এপিবিএন সদস্যদের একাংশ যাত্রীর সাথে দর্শনার্থী থাকলে তাদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৫০–৫০০টাকা আদায় করছে। নিরাপত্তা চেক ও মালামাল স্ক্যানের ক্ষেত্রে যাত্রীদের অসচেতনতায় অনেক সময় হ্যান্ডব্যাগে পরিবহনযোগ্য নয়, এমন পণ্য থেকে যায়। যেসব বস্তু কেবিন প্যাকেজে পরিবহন করা যায় না, তা পরিবহনের জন্য যাত্রীরা চেকড ব্যাগেজ ব্যবহার করে। সিভিল এভিয়েশন নিরাপত্তা বিভাগের কর্মীদের একাংশ ২০০–৫০০ টাকার বিনিময়ে ধাতব বস্তু ও পচনশীল বস্তু ক্যাবিন ব্যাগে বহনের সুযোগ করে দেয়। এসব পণ্য সাধরণত ক্যাবিন ব্যাগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার শংকায়। প্রবেশের সময় যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত বাংলাদেশি টাকা থাকলে নিরাপত্তা কর্মীরা তা জোর করে আদায়ের চেষ্টা করেন।

চেক ইন এবং বোর্ডিং পাস সংগ্রহের ক্ষেত্রে, একই সময়ে একাধিক এয়ারলাইন্সের বিমান উড্ডয়ন নির্ধারিত থাকলে এয়ারলাইন্সগুলোকে আন্তর্জাতিক রুটের ১০টি কাউন্টার যৌথভাবে ব্যবহার করতে হয়। এতে চাহিদার তুলনায় কাউন্টারের স্বল্পতা দেখা যায়। কাউন্টার স্বল্পতার জন্য সেবা প্রদান বিঘ্নিত হয়। কাউন্টারে যাত্রীদের দীর্ঘ সারি হয় এবং সেবা পেতে দেরি হয়। কাউন্টারে যাত্রী সংখ্যা বেশি হলে সেবা পাওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়। বিমানবন্দর ত্যাগের পূর্বে প্রত্যেক যাত্রীকে বহির্গমন কার্ড বা ইডি কার্ড ইমিগ্রেশন ডেস্কে জমা দিতে হয়। চট্টগ্রামে বিমানবন্দর ব্যবহারকারীর অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক। এদের অনেকেই ইডি কার্ড পূরণ করতে না, সেখানে কার্ড পূরণে আনুষ্ঠানিক কোন ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে ৫০–১০০টাকার বিনিময়ে সিভিল এভিয়েশন, ইমিগ্রেশন, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের একটি অংশ এ কার্ড পূরণ করে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে সকল যাত্রী ভিজিট ভিসা নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছেন, তাদেরকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইমিগ্রেশন কর্মীদের একাংশ ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহায়তা করছেন। এক্ষেত্রে ৩০–৩৫ হাজার টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভিজিট ভিসার কোন কোন যাত্রীর বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে হয়রানি করা হয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে অতিরিক্ত অর্থও প্রদান করতে হয়। একজন যাত্রীর ব্যবসা সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও ইমিগ্রেশন কর্মীরা তাকে আড়াই ঘন্টা আটকে রাখার একটি উদাহরণ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনটিতে। ভিসার মেয়াদ কম, ছবি ঠিক নেই এসব অজুহাতেও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূত ১০০–৫০০টাকা আদায় করে থাকে। অনেক সময় ইচ্ছে করেই যাত্রীর জিনিস লুকিয়ে রেখে ৫০–১০০০টাকা বকশিস আদায় করছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

চূড়ান্ত নিরাপত্তা তল্লাশির ক্ষেত্রে, ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র নেয়ার পর যাত্রীদের লাগেজ পুনরায় স্ক্যনিং করা হয়। যাত্রীরা অনেক সময় অনুমোদিত মুদ্রা থেকে বেশি পরিমাণে দেশি–বিদেশি মুদ্রা বহন করে। এই অতিরিক্ত মুদ্রা নিরাপত্তা কর্মীদের একাংশ জোরপূর্বক আদায় করে থাকে। মূলত, এই অতিরিক্ত মুদ্রা আটকের এখতিয়ার কাস্টমস কর্তৃপক্ষের রয়েছে।

বিদেশগামী যাত্রী বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে পার্কিং এর দায়িত্বে নিয়োজিতরা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কারণে পরবর্তীতে তা যাত্রী সাধারণের গায়ের ওপর পড়ছে। এছাড়া শুল্ক বিভাগের কর্মীদের একাংশের সহায়তায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০০০–১৪০০০টাকা অর্থের বিনিময়ে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য অথবা শর্ত সাপেক্ষে আমদানি যোগ্য পণ্য শুল্ক ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করানোর অভিযোগ রয়েছে। বকশিসের বিনিময়ে লস্ট এন্ড ফাউন্ড থেকে পাসপোর্ট ছাড়াই পণ্য ছাড় করা যায়। এদিকে বিমানবন্দরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ফ্লাইটগুলোর ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ফ্লাইটগুলোতে সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে ফ্লাইটের অধিকাংশ যাত্রীকে ম্যানুয়ালি চেক করা হয়। এক্ষেত্রে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। যাত্রীর ব্যাগ খুলে ফেলা ও অনেক যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাসহ ইত্যাদি।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা ৪.৯৪ ও ৩.১৫ গুন বাড়লেও বিমানবন্দরটিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।

২০০০ সালে “চিটাগাং এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট”র আওতায় যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় তা ৬ লাখ যাত্রীকে সেবা দিতে সক্ষম, কিন্তু বর্তমানে একই অবকাঠামোয় ১২.৫ লাখের বেশি যাত্রীকে সেবা দিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

বিমানবন্দরে কাজের পরিধি, যাত্রী সংখ্যা এবং ফ্লাইট সংখ্যা পূর্বের তুলনায়বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী লোকবল বাড়েনি। সেখানে ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী লোকবল আছে।

গ্রাউন্ড সাপোর্টে যন্ত্রপাতি অপর্যাপ্ত, যন্ত্রপাতির ৩৭ শতাংশের বেশি যন্ত্রপাতি আংশিক ব্যবহারের উপযোগী নয়। অনেক সময় একটি বিমানের সরঞ্জাম দিয়ে আরও দুটি বিমানের সেবা দিতে হয়। ফলে যাত্রী সেবা কার্যক্রমে মন্থর গতি দেখা যায়। এ সময় যাত্রী সেবার মান সুনিশ্চিতে তাদের পক্ষ থেকে ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা জানানো হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে, টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ, প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, নতুন বোর্ডিং ব্রিজ ক্রয় এবং সংযোজনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ, পর্যাপ্ত চেক ইন ও ইমিগ্রেশন বুথ কাউন্টার বাড়ানো, অধিক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য লস্ট এন্ড ফাউন্ডের ওয়ার হাউজের আয়তন বাড়ানো, পণ্য ব্যবস্থাপনায় তদারকি বৃদ্ধি, ম্যানুয়ালি কাজ করার হার কমানো, বহির্গমন কার্ড পূরণে পৃথক ডেস্ক স্থাপন করা, নিরাপত্তা তল্লাশী, ইমিগ্রেশন, শুল্কসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যাত্রী হয়রানি বন্ধে তদারকি বৃদ্ধি ও জড়িতদের শাস্তি দেয়া, অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন ও অভিযোগ লিপিবদ্ধকরণ ও নিষ্পত্তিকরণ রেকর্ড সংর ণের পাশাপাশি প্রকাশ করাসহ ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সনাক সহ সভাপতি অধ্য আনোয়ারা আলম, সহ সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া, টিআইবি’র সাধারণ পরিষদ সদস্য ও সনাক চট্টগ্রাম মহানগরের সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি, টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের এরিয়া ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম।

আজাদী প্রতিবেদন - শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ - ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

Comments