নগরের ফ্লাইওভারগুলো ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ রাখা হোক
খবরের বিবরণে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি খুলে দেওয়া হয় আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার। চালুর পর থেকে ফ্লাইওভারের ওপর একাধিক দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়া ফ্লাইওভারের লুপ ও র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় ফ্লাইওভারটির একটি লেন বন্ধ রেখেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। মাত্র একটি লেন দিয়ে উভয়মুখে যান চলাচলের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়েছে। এ বছরের ২৫ জানুয়ারি ফ্লাইওভারটিতে একজন নিহত হওয়ার আগে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর দুর্ঘটনায় একজন মোটর সাইকেল আরোহী প্রাণ হারান। একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর লালখান বাজার এলাকায় ফ্লাইওভারের ওপর বাসের ধাক্কায় নিহত হন আরো এক মোটর সাইকেল আরোহী। ওই মাসেই মোটর সাইকেলের আরো দুই আরোহী দুর্ঘটনায় নিহত হন। এছাড়া ২০১৬ সালে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার থেকে নিচে নামার সময় পণ্যবাহী ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন দুই অটোরিকশা যাত্রী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের প্রবেশ ও বহির্গমনের মুখে যানজট লেগে থাকায় দুর্ঘটনায় পড়ছে বিভিন্ন যানবাহনে। আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর পর এখন পর্যন্ত পথিমধ্যে কোন ট্রাফিক সাইন না বসানোর কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ফ্লাইওভারে দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত লাইটিং ও ট্রাফিক সাইনের ব্যবহার না বাড়ানো গেলে ফ্লাইওভার আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে ঝুঁকিমুক্তভাবে যাতে যান চলাচল করতে পারে, সেজন্য বন্ধ করা লেনটি খুব শীঘ্রই খুলে দেওয়া হবে বলে জানান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)নির্বাহী প্রকৌশলী ও আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের পরিচালক। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনের স্বার্থে নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ না করেই আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি লুপ ও র্যাম্প নির্মাণের জন্য একটি লেন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। লুপ ও র্যাম্পের কাজ শেষ হয়ে আসায় কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ লেনটি খুলে দেয়া হবে। ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে প্রথম বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ ২০১০ সালে শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হয়। মাঝে ২০১২ সালে নির্মাণ ত্রুটিতে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন নিহত হন। বড় এ দুর্ঘটনার কিছুদিন আগেও ফ্লাইওভারটির একটি গার্ডার ধসে পড়ে। যদিও ওই ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি। লুপ চালু হওয়ার প্রায় তিন বছর পর সিডিএ ফ্লাইওভারটিতে ৩০০ মিটারের র্যাম্প নির্মাণ করে। গত বছর ১৬ ডিসেম্বর র্যাম্পটির উদ্বোধন করা হয়। তবে মূল ডিজাইনের বাইরে র্যাম্প নির্মাণ করায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের সঙ্গে র্যাম্পটি কৌণিকভাবে সংযুক্ত হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে সড়কের যেকোনো সংযুক্তি অর্ধবৃত্তাকার হওয়ার কথা থাকলেও কৌণিক অবস্থানের কারণে ফ্লাইওভারটিতে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০১২ সালে কাজ শুরু হয়ে ১ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়ক বিভাজক বা ডিভাইডারবিহীন কদমতলী ফ্লাইওভারটির উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ডিভাইডার দেয়া জরুরি। এছাড়া স্পিড ব্রেকার না থাকলেও ফিউশন ব্রেকার(সীমিত গতিরোধক) দেয়া উচিত। তা না হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন,চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণের আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। এরপর দুটি ফ্লাইওভারের মূল কাজ শেষ হওয়ার পর লুপ ও র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ফ্লাইওভারের মূল কাঠামোর সঙ্গে লুপ ও র্যাম্পগুলোর সমন্বয় থাকছে না। একটি আধুনিক ও নিরাপদ ফ্লাইওভারের জন্য দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা জরুরি। কিন্তু চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোয় পরিকল্পিত কোন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই। এ প্রসঙ্গে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ফ্লাইওভারে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের এরই মধ্যে ফ্লাইওভারে যানবাহন চলাচলের একাধিক সতর্কতামূলক সাইন সংবলিত ব্যানার–পোস্টার লাগানো হয়েছে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে আনার বিষয়টি শিগগিরই ট্রাফিক বিভাগকে অবহিত করা হবে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে অসহনীয় যানজট থেকে মুক্তি পাওয়াসহ নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাকে সচল ও বেগবান রাখার স্বার্থেই মহানগরীতে একাধিক উড়ালপুল বা ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও যদি মহানগরীর ফ্লাইওভারগুলো থেকে মানুষ কোন প্রকার সুবিধা না পান, বরং প্রাণটা হাতে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যানবাহন ও মানুষকে চলাচল করতে হয় তাহলে মানুষ যাবেন কোথায়? অর্থেরও অপচয় নয় কি? দেখা যাচ্ছে, নগরীর ফ্লাইওভারগুলোর নিরাপত্তা বেষ্টনি পর্যাপ্ত নয়। মাত্র দু’টি ফ্লাইওভারে ডিভাইডার থাকলেও অন্য দুটি ডিভাইডারবিহীন। অধিকাংশ সময়ই এসব ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলাচল করে। ফ্লাইওভারগুলোতে যান চলাচল তুলনামূলকভাবে কম থাকায় ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা বেশি। এসব অব্যবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ফ্লাইওভারগুলো। যত শীঘ্র সম্ভব এইসব অব্যবস্থা দূর করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষ মরবেন, যানবাহন নষ্ট হবেণ্ড এটা সহনীয় হতে পারে না। পর্যাপ্ত লাইটিং ও ট্রাফিক সাইনের ব্যবহার না বাড়ানো, মূল ডিজাইনের বাইরে র্যাম্প নির্মাণ, ডিভাইডারবিহীন সীমিত গতিরোধক বা ফিউশন ব্রেকার না দেয়া ইত্যাদিতে প্রাণহানি হওয়া ভয়াবহ ব্যাপার। খবরে আরো একটি শিহরণ জাগানো বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি হলো,মহানগরীর ফ্লাইওভারগুলো নাকি নির্মাণের আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। কেন যাচাই করা হলো না তার জবাব অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি ফ্লাইওভারের মূল কাজ শেষ হওয়ার পর লুপ ও র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে বিধায় ফ্লাইওভারের মূল কাঠামোর সঙ্গে লুপ ও র্যাম্পগুলোর সমন্বয় থাকছে না। এমন ত্রুটিপূর্ণভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাম্য নয়। তাছাড়া একটি নিরাপদ ফ্লাইওভারের জন্য দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ট্রফিক আইন অমান্যকারীদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা জরুরি হলেও মহানগরীর ফ্লাইওভারগুলোয় কোন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই। আমরা মনে করি, এই জরুরি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু নজর দেওয়া অত্যাবশ্যক। মোটকথা, এরকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মহানগরীর ফ্লাইওভারগুলো রাখা কোন ক্রমেই উচিত নয়। এখনকার ফ্লাইওভারগুলো অবিলম্বে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ হোক্ণ্ড এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সম্পাদকীয় - দৈনিক আজাদী - ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ
No comments