সিডিএকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত মেয়রের



বর্ষাকে সামনে রেখে গত ৭ জানুয়ারি নগরীর ৫৭ খালে খনন শুরু করেছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ইতোমধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩০ শতাংশ কাজ শেষও করে সংস্থাটি। এদিকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে তাদের গৃহীত মেগাপ্রকল্পের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। সিদ্ধান্তের আলোকে খুব শীঘ্রই প্রকল্পের আওতায় জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কাজ শুরুর ঘোষণাও দেয় সংস্থাটি। সিডিএ কাজ শুরু করার ঘোষণা দেয়ার পর প্রশ্ন ওঠেছে, সিটি কর্পোরেশন তাদের চলমান কাজ অব্যাহত রাখবে নাকি বন্ধ করে দেবে?এক্ষেত্রে কাজ চলমান রাখলেও সিডিএ কাজ শুরু করার পর ‘ওভারলেপিং’ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার সিডিএ’র প্রকল্পে সংস্কার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আছে, যা কর্পোরেশনের নেই। তাই কর্পোরেশন কাজ অব্যাহত রাখলে অর্থ সংস্থান কীভাবে হবে সেটা নিয়েও সংস্থাটির কর্মকর্তাদের প্রশ্ন আছে। এমন পরিস্থিতিতে, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি নিয়ে সিডিএকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। চিঠিতে মেয়র, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক খাল সমূহের খনন এবং খালপাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সিডিএ’র সুস্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাইবেন। যাতে করে এ কার্যক্রমে কোন ওভারলেপিং না হয়।’ একই বিষয়ে মেয়র স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়ে করণীয় জানতে চাইবেন। ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক খালসমূহ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ‘টাস্কফোর্স’র এর দ্বিতীয় সভায় চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্তটি হয়। গতকাল নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিডিএকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সিডিএকে চিঠি লিখব। এতে তাদের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইব। আমাদের কোনো করণীয় থাকলে বা সহযোগিতা চাইলে সেটাও করবো। আর যদি আমরা করি, কিভাবে করবো সেটা জানতে চাইব।’ মেয়র বলেন, ‘খাল পাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য তাদের প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ আছে। উচ্ছেদের পর খাল পাড়ে রাস্তা তৈরি করতে হবে। যাতে খাল সংস্কারে সুবিধা হয়। এগুলোও প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং বরাদ্দও আছে। এখন আমরা যে খনন করছি, খাল পরিষ্কার করছি সেই কাজ কি অব্যাহত রাখবো নাকি বন্ধ করে দিব এই বিষয়ে সিডিএর কাছে জানতে চাইব। এখন আমরা যদি করি তার জন্য তো অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।’ এদিকে বৈঠকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সিডিএ’র প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে কোন চিঠি দেয়া হবে কী না জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে জানাব। সেনাবাহিনীকে তো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দেয় নি। তাদের সঙ্গে সমাঝোতা স্মারক হবে। এরপর সেনাবাহিনী হয়তো সবার সঙ্গে বসবেন। মেয়র বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিব।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাথাব্যথা তো বেশি। আমরা এখন মাটি উত্তোলন করছি। আবার সেখানে একটি প্রকল্প ধরা আছে। আমাদের অর্থও ব্যয় হচ্ছে। যদিও আমাদের জন্য আলাদা কোন অর্থ বরাদ্দ নাই। তবু নগরবাসীর অসুবিধার কথা বিবেচনা করে কাজ করে যাচ্ছি।’ ‘সিডিএ’কে চিঠি দিলে সেইক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত চসিকের চলমান সংস্কার কাজ অব্যাহত থাকবে কী না জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘চলমান থাকবে।’ এদিকে গতকালকের বৈঠকে সিডিএ’র প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহিনুল ইসলাম খান। মেয়র তার কাছে সিডিএ’র প্রকল্পটি নিয়ে জানতে চান বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা যে কাজগুলো (খাল খনন) করছি সে একই কাজ সিডিএ’র প্রকল্পেও অন্তর্ভুক্ত আছে। একই ধরনের কাজ হওয়ায় আমাদের আলাদা করে করার সুযোগ নেই। কারণ, এতে ওভার লেপিং হবে। তাই মিটিংয়ে আসা সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের কাছে প্রকল্প নিয়ে ওনার ধারণা বা সিডিএ’র পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। যেহেতু ওই প্রকল্পের (সিডিএ’র গৃহীত) প্রথম ধাপে জরুরি ভিত্তিতে কিছু কাজ করার কথা এবং এ বিষয়ে জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ অনুষ্ঠিত প্রকল্প সংক্রান্ত মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন প্রায় এক মাস অতিক্রম হয়ে গেছে। তবু কাজ শুরু না হওয়ায় জানতে চেয়েছি। যদিও এ বিষয়ে সন্তোষজনক কিছু বলতে পারেননি তিনি(সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ)। মেয়র বলেন, সিডিএকে প্রথম ধাপে যে কাজ করতে বলা হয়েছে, ‘সেখানে রাস্তার পাশে স্থিত যে ড্রেন আছে সেখান থেকে ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার করা, খাল খনন, মাটি উত্তোলন করতে বলা হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে রেগুলেটার বসানোর কথা। ওসব বিষয়ে জানতে চেয়োছিলাম।’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট মেয়রকে প্রধান করে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক খালসমূহ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর কিছুদিন পর ১১ সেপ্টেম্বর উক্ত টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে আর কোন সভা হয়নি। এ নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘খাল পাড়ের দখল উচ্ছেদে দৃশ্যমান তৎপরতা নেই, নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে উঠছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এরপর গতকাল অনুষ্ঠিত হল দ্বিতীয় সভা।

এদিকে গতকালকের সভায় চসিক মেয়র বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক)মাধ্যমে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তার বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। এ নিয়ে জনগণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাকে ভুল বুঝুক তা আমি চাই না। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক খাল সমূহের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন। যাতে করে এ কার্যক্রমে কোন ওভারলেপিং না হয়।’

মেয়র খাল থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে মূল কাজ যেহেতু সিডিএ বাস্তবায়ন করবে, সেহেতু খালের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এর ক্ষেত্রে কিছু আর্থিক বিষয় রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয় এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও চউক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানা গেলে এ কার্যক্রমের সুফল মিলবে বলে আশা করা যায়।’

মেয়র আরো বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ১৫ টি খাল থেকে মাটি উত্তোলন এর কাজ শুরু করেছি। এছাড়াও নগরীতে আরো ২২ টি শাখা খাল রয়েছে। সবগুলো খাল পরিষ্কার হলে জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব কমবে। সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের ভু–সম্পত্তি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, অপচনশীল বর্জ্য জলাবদ্ধতার জন্য দায়ি। এ ধরনের বর্জ্য ভাটার সময় নদীর তলায় আটকে থাকে। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ুইচ গেট এর মাধ্যমে জলাবদ্ধতা সংকটের নিরসন প্রকল্প নিয়েও দ্বিমত পোষণ করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ সচিব ও বিভাগীয় ভু–সম্পত্তি কর্মকর্তা ইশরাত রেজা বলেন, নগরীর ১৬ টি খালের পাড়ে রেলের জায়গা রয়েছে তাতে যদি অবৈধ স্থাপনা থাকে তা আমরা উচ্ছেদ করব। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, সিডিএ’র প্রকল্পের সাথে আমাদের গৃহীত অনেকগুলো প্রকল্পের ওভারলেপিং আছে যা আমরা সংশোধন করব।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নগরীর বিভিন্ন খাল থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। প্রথমদিন মহেশখালে এ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। এতে নেতৃত্ব দেন স্বয়ং মেয়র। প্রথমদিন ৩৫ টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আরো দুইদিন এই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে গত ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (্‌একনেক) সভায় সিডিএ’র গৃহীত ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুন:খনন, সম্প্রসারণ. সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩৬টি খালকে সংস্কার করার কথা জানায় সিডিএ। পরবর্তীতে সিডিএ’র প্রকল্পে খাল সংস্কারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকায় জটিলতা এড়াতে খালপাড় থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল চসিক।

গতকালের সভায় উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর এম আশরাফুল আলম, এ এইচ এম সোহেল, নাজমুল হক ডিউক, ইসমাইল বালী,চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব মোহাম্মদ আবুল হোসেন, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ড. মুস্তাফিজুর রহমান, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিয়া শিরিন, প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্ণেল মহিউদ্দিন আহমদ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহিনুল ইসলাম খান, বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি সিনিয়র সহকারী কমিশনার (রাজস্ব) মোহাম্মদ রুহুল আমিন, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, বন্দর কর্র্তৃপক্ষের ভু–সম্পত্তি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার জিল্লুর রহমান, রেলওয়ের উপ সচিব ও বিভাগীয় ভু–সম্পত্তি কর্মকর্তা ইশরাত রেজা, চসিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিয়া আখতার, স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট ও যুগ্ম জেলা জজ জাহানারা ফেরদৌস, উপ পুলিশ কমিশনার (সদর) শ্যামল কুমার নাথ, চসিক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর এসএসও নিউটন দাস, পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা খন্দকার মো. তাহাজ্জুত আলী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

আজাদী প্রতিবেদন : শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

Comments