Header Ads

Header ADS

বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চ রাতের বার্তা: চট্টগ্রাম কিভাবে পেয়েছিল!



মঈনুল আলম : ১৯৭১এর ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে ইত্তেফাকের অফিস-কাম-আমার আবাসিক ফ্ল্যাটে কি অস্থিরতায় রাত কাটাচ্ছি! আমার দুটি টেলিফোন অনবরত বেজে উঠছে। সকলেই জানতে চাচ্ছে, ঢাকায় কি হচ্ছে?
আমি জবাব দিতে পারছিনা, কারণ রাত ১১টার পর হতে ঢাকার সাথে এবং বাইরের দুনিয়ার সাথে চট্টগ্রামের সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আমি ও আমার স্ত্রী নার্গিস ড্রয়িং রুমের ডিভানে পাশাপাশি শুয়েছি বিপরীত মেরু করে, অর্থাৎ আমার মাথার পাশে তার পা, আর তার পায়ের পাশে আমার মাথা। দু’ জনের কানের পাশে দুটি টেলিফোন রেখেছি। টেলিফোন দুটি বারবার বেজে উঠছে। দু’ জনেই জওয়াব দিচ্ছি। কিন্তু একজনের কথা বলা আরেক জনের কথা বলাতে শোনা যাচ্ছে না। এ ভাবেই চোখে একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো। হঠাৎ শুনলাম দূরে অবিরাম মেসিনগানের গুলিবর্ষণের টা টা টা শব্দ। মনে হলো নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্টের দিক হতে আসছে গোলাগুলির শব্দ!

এ ভাবে আধো তন্দ্রা আধো জাগরণে রাত কাটলো। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি ভোর ৬টা। কোথা হতে সংবাদ জোগাড় করি? মনে পড়লো (সীতাকু- ও মীরসরাই-এর কাছাকাছি) ছলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনের কথা। ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের টেলি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ওদের হয়ত যোগাযোগ থাকতে পারে। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক সময় ছলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশন হতে সাহায্য পেয়েছি।

এখন ভোর সাড়ে ছয়টা। আমি ফোন করতেই সাড়া দিলেন স্টেশনে ডিউটিরত সহকারী প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী ডাকুয়া। তিনি বেশ উত্তেজিত। বললেন, কাল রাতে ঢাকার সাথে টেলি-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে শেখ সাহেবের কাছ হতে একটা মেসেজ এসেছে। এটা জানানোর জন্য চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ফোনে কাউকে তিনি পাচ্ছেন না।

আমি সাগ্রহে বললাম, বার্তাটি পড়েন, আমি লিখে নিচ্ছি।
বার্তাটি ইংরেজিতে। গোলাম রব্বানী পড়লেন, আমি লিখে নিলাম: "Message to the people of Bangladesh and the people of the world. Rajarbagh police camp and Peelkhana EPR suddenly attacked by Pak Army at 2400 hours. Thousands of people killed. Fierce fighting going on. Appeal to the world for help in freedom struggle. Resist by all means. May Allah be with you. Joy Bangla.! Message from Sheikh Mujibur Rahman "

আমার শরীরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল। কাল রাত হতে যে চরম অস্থিরতায় সময় কাটছিলো এক মুহূর্তে তা কেটে গেল। এখন কি ঘটছে আমি তার একটা ধারণা করতে পারছি। আমার কি কর্তব্য সে সম্পর্কেও আমি একটা পথরেখা দেখতে পাচ্ছি। ডাকুয়াকে বললাম, আমি এখনই এ বার্তা যথাস্থানে পৌঁছে দিচ্ছি। আমার ফোন নম্বর দুটি দিয়ে অনুরোধ করলাম, আর কোন খবর পেলে যেন সাথে সাথেই আমাকে জানান।

বার্তাটি কয়েকবার পড়লাম। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে বার্তাটি বঙ্গবন্ধুর কাছ হতে এসেছে। বিশেষ করে বার্তাটির শব্দ প্রয়োগের ধাঁচে আমাদের পরিচিত বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাচ্ছিলাম। “লাখ লাখ মানুষ মরছে”, “তোমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ কর”, “আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন”। এ সব ভাষায় যেন আমি বঙ্গবন্ধুর দরাজ কন্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। দ্রুত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বার্তা পৌঁছে দিই এ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের কাছে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী প্রেসিডেন্ট এম, আর, সিদ্দিকীর কাছে।

এম, আর, সিদ্দিকী গত রাত হতে তাঁর বাসভবনে নেই। জনাব এ, কে, খানের বাসভবনে ফোন করে সিদ্দিকী সাহেবকে চাইলাম। … বেগম লতিফা সিদ্দিকী (কোহিনূর আপা) ফোনে এলেন। আমার কাছ হতে দ্রুত বার্তাটি লিখে নিয়েই কোহিনূর আপা প্রশ্ন রাখলেন: আপনি ফরেন প্রেসকে এ বার্তা দিয়েছেন তো? আপনার দেওয়া উচিত।

বললাম: আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি।

বললাম বটে, কিন্তু কি উপায়ে বার্তাটি বিদেশে পাঠানো যায়? সব টেলিযোগাযোগ ত বন্ধ। আমার দুই ঘনিষ্ট বন্ধু দৈনিক পিপল্স ভিউ সম্পাদক নুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনের নিউজ এডিটর সুলতান আলীর সাথে ফোনে পরামর্শ করলাম। তারাও কোন উপায় বাৎলাতে পারলো না।

ঠিক করলাম সব প্রয়োজনীয় সরকারী অফিস ও আধা সরকারী অফিসে আমার পরিচয় না দিয়ে ফোনে বার্তাটি জানিয়ে দেব। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার হতে শুরু করে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট পর্যন্ত যেখানে যেখানে কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল, সে সব জায়গায় ফোন করলাম। আমার পরিচয় দিলাম না; তাঁরা সাগ্রহে বার্তাটি লিখে নিলেন। এ ভাবে অনেকগুলি ফোন করলাম । মাত্র দুটি অফিসে বার্তাটি নিতে অসম্মত হল । তাদের দাবী ছিল: আগে বলেন আপনি কে বলছেন। কিন্তু আমি পরিচয় দিতে অস্বীকার করলাম।

কোহিনূর আপার কাছ হতে বার্তাটি পেয়েই এম, আর, সিদ্দিকী আমাকে ফোন করলেন। আলোচনায় ঠিক হলো, আমি তাঁকে সব ডেভেলপমেন্ট অবহিত করে যাব। তবে, ফোনে তাঁকে ‘সিদ্দিকী’ বলা যাবে না। তাঁর ডাক নাম ‘আলম’ বলেই সম্বোধন করবো। আমি তো অরিজিনাল ‘আলম’ আছিই।

সুলতান আলী ফোন করলেন। বললেন, আগ্রাবাদ ব্রডকাস্টিং হাউস তো অচল। ওঁরা কালুরঘাটের চান্দগাঁও ট্রান্সমিশন স্টেশনটি ব্যবহার করছেন না কেন?”

আমি বললাম: চান্দগাঁও স্টেশনে কি ব্রডকাস্টিং স্টুডিও এখনও আছে?

সুলতান আলী উত্তেজিত ভাবে বললেন, হাঁ আছে। আগ্রাবাদ ব্রডকাস্টিং হাউসের কোন সাহায্য ছাড়াই চান্দগাঁও স্টেশন হতে সরাসারি ব্রডকাস্টিং করা যায়। ওঁদের বলেন, যা কিছু ওখান হতে ব্রডকাস্ট করতে।

তথ্যটি পেয়ে আমি উল্লসিত হয়ে তখনই সিদ্দিকী সাহেবকে ফোন করে জানালাম। টেকনিক্যাল ব্যাপারটি জেনে সিদ্দিকী অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হলেন। আগ্রাবাদ রেডিও হাউস ছাড়া ব্রডকাস্টিং করা যায় না, এ ধারণায় তাঁরা বেতারে প্রচারের চিন্তা মন থেকে বাদ দিয়েই বসেছিলেন। এখন সানন্দে বললেন: আমি এখনই দেখছি।

চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট এম, আর, সিদ্দিকীর প্রচেষ্টায় ২৬ শে মার্চ শেষ বিকেলের দিকে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম, এ, হান্নান নিজের পরিচয় না দিয়ে চান্দগাঁও রেডিও স্টেশন হতে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি পাঠ করে ব্রডকাস্ট করেন। তবে, সে সময়ের দারুণ অস্বস্তিকর সময়ে খুব কম লোকই জানতো যে চট্টগ্রাম বেতারের কোন ব্রডকাস্টিং হতে পারে। তাই এম, এ, হান্নানের এ প্রচার খুব কম সংখ্যক লোকই জানতে পেরেছিল।

তবে চট্টগ্রাম বেতারের চান্দগাঁও স্টেশনের ব্রডকাস্টিং ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই জেগে উঠলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রামের বুকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়!

লেখক: চট্টগ্রামের প্রবীণতম সাংবাদিক, প্রবাসী।

No comments

Powered by Blogger.