চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। প্রথমে এর বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-সমাবেশ ঘটলেও ক্রমে তা সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন গড়ে ওঠে কবি-লেখক-সংস্কৃতিতকর্মীদের নেতৃত্বে।
১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে ৪ দিনব্যাপি সংস্কৃতি সম্মেলনে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সভাপতির যে ভাষণটি প্রদান করেন সেটি পূর্ব বাংলার স্বাধিকার চিন্তা ও জাতির সাংস্কৃতিক আধারকে বেগবান করে তোলে, ঐ ভাষণে তিনি বলেন, ‘মানুষের মানুষে বিভেদ আছে সত্য। এই বিভেদকে জয় করাই শক্তি। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন, বিভেদের চামুণ্ডা নয়।’
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত আন্দোলন-সংগ্রামের তুঙ্গপর্বে চট্টগ্রামের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন দেশব্যাপি লেখক-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যাপক অনুপ্রেরণা দেয়। এই সম্মেলনের প্রভাবে চট্টগামে গণতান্ত্রিক ও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনও জোরদার হয় এবং পাকিস্তানের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তরুণ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক, আওয়ামী মুসলিম লীগ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ ও রেল শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। কমিটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব, যুব সম্প্রদায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শ্রমজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন।
চট্টগ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য, ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আবদুল্লাহ আল হারুনকে আহ্বায়ক, মোহাম্মদ আলী (চবি প্রাক্তন ভিসি) ও ফরিদ উদ্দিন আহমদ (সাংবাদিক, কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) কে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। চট্টগ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
ভাষা আন্দোলনের ডাক চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃত্বের পাশাপাশি রাজনীতিসচেতন শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও তরুণ লেখকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তারা চট্টগ্রাম শহর ও গ্রামাঞ্চলে গণসংগীত, কবিগান ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ও পূর্ব বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার চেতনা ছড়িয়ে দেন।
সূত্র : চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন, শরীফ শমসির ও নানা সাময়িকী
No comments