Header Ads

Header ADS

চট্টগ্রামের সাড়ে চার হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস

প্রাচীন এ চট্টগ্রামের বয়স নির্ণয় নিয়ে বেশকিছু মতেবিরোধ আছে। ধারণার ওপর বলা হতো হাজার বছরের চট্টগ্রাম। তবে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর ৩৫ বছর পূর্তিতে বিশেষ সংখ্যায় হাজার বছরের চট্টগ্রাম বলা হয়েছে। অবশ্যই আমরা চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চাকেন্দ্র ও প্রত্নতত্ত্ব আলোকচিত্রি মিউজিয়াম ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের এক হাজার বছর পূর্তি উৎসব করলে অনেক ইতিহাস গবেষক এর প্রতিক্রিয়ায় হাজার বছরের কথায় তাদের মতবিরোধ লক্ষণীয় ছিল। আর আমাদের চট্টগ্রামের ওপর যারা ইতিহাস গবেষণা ও রচনা করেছেন তারা সবাই যারযার তথ্য-উপাত্তের ওপর লিখেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মেধাবী ছাত্র মোঃ শাহীনুজ্জামান (শাহীন) তার গবেষণায় প্রমাণ করছেন এ চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগেও মানব বসতি ছিল। তিনি চট্টগ্রামে নব্য প্রস্তর যুগের প্রত্ন নির্দশন আবিষ্কার করেন।। ‘২০১২ সালের ১৯ এপ্রিলে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চাকেন্দ্রের আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিজ্ঞ আলোচকগণ বলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্ননিদর্শন ও ঐ যুগের সূত্রের মাধ্যমে ইতিহাস রচিত হলে চট্টগ্রামই বাঙালী জাতিগোষ্ঠীর বীজকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হবে। কেননা ইতিহাস গবেষণা ও ২০০৮ সালের ঢাকা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধানী প্রত্নতত্ত্ব গবেষক শাহীনুর জ্জামান দীর্ঘদিন গবেষণা অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া দুটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের নির্দশনে প্রমাণিত হয়েছে যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগেও মানব বসবাস ছিল। নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা এমনিতেই অনুমান করতেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের এলাকায় আজ হতে ৩/৪ হাজার বছর আগে ও মানব বসতি ছিল, ১৯ এপ্রিল ২০১২, দৈনিক আজাদী’, ভারতীয় সভ্যতার অমূল্য স্বাক্ষর মহাভারতের বিভিন্ন স্লোকে চট্টগ্রামের আদিনাথ, চন্দ্রনাথ, কাঞ্চন নাথের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সূত্রে যদি মহাভারত সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে রচিত হয়, আর উল্লিখিত তিনটি স্থান যথাযত চট্টগ্রামের হয়, তাহলে চট্টগ্রামের বয়স সাড়ে ছয় হাজার বছর ও হতে পারে। প্রাচীন এ চট্টগ্রামের বয়সের ভারে যতদিন অতিবাহিত হচ্ছে, ততই সমৃদ্ধির সাথে এগিয়ে চলছে আধুনিক বিশ্বের সাথে। সেই প্রাচীন সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ চট্টগ্রামের ৩৭টি নাম পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম বা চিটাগাং এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাচীন সে নামগুলোÑ ১) আদর্শদেশ, ২) সুহ্মদেশ, ৩) ক্লিং বা কালেন, (৪) রম্যভূমি, (৫) চিতাগাঁও, চিৎগাঁও, ৬) চট্টল, ৭) চৈত্যগ্রাম, ৮) সপ্তগ্রাম, ৯) চট্টলা, ১০) চট্টগ্রাম, ১১) চক্রশালা, ১২) চন্দ্রনাথ, ১৩) চরতল, ১৪) চিতাগঞ্জ, ১৫) চাটিগাঁ, ১৬) শ্রীচট্টল ১৭) সাতগাঁও, ১৮) সীতাগঙ্গা, (সীতাগাঙ্গ, ১৯) সতের কাউন, ২০) পুষ্পপুর, ২১) রামেশ, ২২) কর্ণবুল, ২৩) সহরেসবুজ, ২৪) পার্ব্বতী, ২৫) খোর্দ্দ-আবাদ, ২৬) Porto grando (বৃহৎ বন্দর), ২৭) ফতেয়াবাদ, ২৮) আনক, ২৯) রোশাং, ৩০) ইসলামাবাদ, ৩১) মগরাজ্য, ৩২) Chittangon. ৩৩) কিরাত, ৩৪) যতরকুল, ৩৫) চক্রশা, ৩৬) শ্রীযুক্ত কেলিশহর এবং ৩৭) পেন্টাপোলিস।

চট্টগ্রামের ইতিহাস সুপ্রাচীন এ কথা বারেবারে বলা হয়। তবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায়নি। নব্যপ্রস্তর যুগের একটি অস্মীভূত কাঠের অস্ত্র সীতাকুণ্ড অঞ্চলে পাওয়া গেছে। সীতাকু-ের পার্বত্য অঞ্চলে সর্বাধিক পরিমাণে প্রস্তর খণ্ড পাওয়া যায়। এ থেকে পণ্ডিতরা ও ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন যে, এই অঞ্চলেই নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। সম্ভবত, এরা অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর শাখা ছিল। কালক্রমে মঙ্গোল জাতিদের দ্বারা অস্ট্রিক জাতি বিতাড়িত হয় এবং সমগ্র উত্তর ভারত এই জাতির দ্বারা অধ্যুষিত হয়ে পড়ে।

খ্রিস্টজন্মের কিছুকাল আগে থেকেই উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে একটি প্রভাবশালী সংস্কৃতি ক্রমশ পূর্বদিকে বিস্তারলাভ করতে করতে একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এটি ‘আর্যীকরণ’ নামে অভিহিত। হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রসারের সাথে সাথে আর্যীকরণের ঢেউ চট্টগ্রামের তটরেখাও স্পর্শ করে। এর ফলে মোঙ্গোল গোষ্ঠীভুক্ত উপজাতীয়রা হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।

প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় ভৌগোলিকদের বর্ণনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির লিখিত ‘পেরিপ্লাসে’ ক্রিস’ বলে যে স্থানটির বর্ণনা আছে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক স্যার ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে তা সন্দ্বীপে সঙ্গে অভিন্ন। ল্যাসেনের মতে, পেন্টাপোলিস চট্টগ্রামেরই ক্ল্যাসিক্যাল নাম।

প্রাচীন মৌর্য সাম্রাজ্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কিনা- এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যায় না। তবে মৌর্য যুগের ব্রাক্ষী লিপিতে খোদিত একটি পাথর মূর্তির পাদলিপি পূর্ব নোয়াখালীর শিলুয়াতে পাওয়া গেছে। সম্রাট অশোক সুবর্ণভূমির (আধুনিক পেগু) সঙ্গে যে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন চট্টগ্রাম তার প্রায় মধ্যস্থলেই পড়ে।

তিব্বতীয় বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের গ্রন্থে এবং আরাকানের সিথাং মন্দিরের শীলালিপিতে চন্দ্র উপাধিধারী এক দীর্ঘকাল স্থায়ী রাজবংশের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রাজবংশের রাজারা বেশ ক্ষমতাশালী ছিলেন। তারানাথের মতে চন্দ্রবংশীয়দের রাজধানী চট্টগ্রামই ছিল। চন্দ্রবংশীয়দের পরে পালবংশ বাংলায় প্রভুত্ব বিস্তার করে। এ সময়ে আরবদের সঙ্গে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘটে। আরব ভৌগোলিকদের বিবরণে ‘সমন্দর’ বলে যে বন্দরটির উল্লেখ আছে প-িতরা তার সাথে চট্টগ্রাম অভিন্ন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। সমন্দর বন্দরটি পালবংশীয় দিগি¦জয়ী রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল। এ থেকে মনে হয়, ধর্মপালের রাজ্যের বিস্তৃতী চট্টগ্রাম পর্যন্ত ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে পালবংশীয় রাজারা দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে নিজেদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছিল।

পালবংশের পতনের পর ময়নামতী-লালমাই অঞ্চলে কতকগুলো স্বাধীন বা অর্ধস্বাধীন রাজবংশের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সমস্ত রাজবংশের ক্ষমতাশালী রাজারা হয়তো দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তাদের রাজ্যসীমা বর্ধিত করে থাকতে পারেন। প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের কয়েকটি শীলালিপি চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশে আবিষ্কৃত হওয়ায় পণ্ডিতরা মনে করেন, চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশ প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিপূর্বে সমতট রাজ্যের বিস্তৃতী উত্তর চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছিল বলে পণ্ডিত ও ইতিহাস গবেষকদের ধারণা। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলের প্রত্ন সম্পদের ওপর নির্ভর ইতিহাস রচিত হয়। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মোগল ঐতিহাসিক শিহাব উদ-দিন তালিশের বিবরণে বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি চট্টগ্রামের দুর্গ এবং দুর্গের আঙিনায় পীর বদরের আস্তানার কথা উল্লেখ করেন (বদর পীর/ বদর-ই আলম চট্টগ্রাম)। তালিশের সূত্রে আরও জানা যায় যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর সুলতান ফখর-উদ-দিন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এই সুলতানের রাজত্বকালে চট্টগ্রামে নির্মিত মসজিদ এবং সমাধিসৌধ সম্পর্কেও তালিশে উল্লেখ আছে। তিনি এখানে কিছু পুরাকীর্তির খোঁজ পান। মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের শহর চট্টগ্রামের বর্ণনায় পুরাকীর্তির উল্লেখ লক্ষ করা যায়। আনুমানিক ১৬০০-১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু কাব্যে এই বিবরণ রয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, এ সময়ের মনোরম চট্টগ্রাম নগরে অনেক সাধু-সজ্জনের নিবাস ছিল। উঁচু-উঁচু পর্বতে দুর্গের সীমানার মধ্যে ‘বদর আলম’-এর সমাধিসৌধের উপস্থিতির বিষয়টিও কবির নজর এড়ায়নি। এই শতাব্দীরই মাঝামাঝি সময়ের (১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে) তালিশের বিবরণে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়। বাহরাম খানের সমসাময়িক বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (জন্ম ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ) চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ত্রিপুরার দক্ষিণে এবং আরাকান রাজ্যের উত্তরে এই মধ্যবর্তী অঞ্চলের একাংশের নাম ছিল বাঙালা, এবং অপরাংশের নাম ছিল রম্ম (সংস্কৃতে রম্য), ছবির পটের মতো একটি দেশ। আধুনিক চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বাঙালা রাজ্য। নালন্দার অবক্ষয় শুরুহলে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সভ্যতার মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ সময় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এই শহরের বিশাল পণ্ডিত বিহারের খ্যাতি (পণ্ডিত বিহারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় পটিয়ার হাইদগাঁও, পশ্চিম পটিয়ার বড় উঠান ও দেয়াং পাহাড়ে)। বৌদ্ধ পণ্ডিত তিলযোগী এবং বানরতেœর জন্মভূমিও ছিল চট্টগ্রাম। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার জেলার রামুর রামকোটে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিশাল প্রত্নক্ষেত্রের উল্লেখও করা যেতে পারে।

তালিশের পরে প্রায় দু’শো বছর সাহিত্যে বা লিখিত বিবরণে চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। অনেক দিন পর অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় কিছু লোকের পেনশন সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া পরীক্ষা করে তাদের বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে গঠিত একটি কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হয়ে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে আসেন সেনাবাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন পগসন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে ক্যাপ্টেন পগসন্স ন্যারেটিভ ডিউরিংএ ট্যুর টু চাটিগাঁও প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বেশকিছু মুসলিম পুরাকীর্তির বিবরণসহ প্রথমবারের মতো পাওয়া যায় কয়েকটি শীলালিপির পাঠ। পগসন পরিদর্শিত পুরানিদর্শনগুলি হলো- ১. পীর বদরের সমাধি, ২. নবাব আমির-উল-উমরার পাথরে তৈরি মসজিদ, ৩. ইয়াসিন খাঁর মসজিদ, ৪. সুলতান বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহ। এছাড়া তিনটি শীলালিপিবিহীন মসজিদের নাম উল্লেখ করেন তিনি। এগুলো হলোÑ ১. ওয়ালি বেগ খান, ২. মির ইয়াহিয়া এবং ৩. মোল্লা সাঁই মসজিদ। পগসন তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের চার মাইল উত্তরে জাফরাবাদে স্যার উইলিয়াম জোন্সের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে বাড়িটির ভূমি-নক্শা ও লেখচিত্র তৈরি করেন। এছাড়া তিনি শহরে ইউরোপীয়দের কবরখানা এবং সীতাকুন্ড পরিদর্শনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।

পগসনের ন্যারেটিভ মুদ্রিত হওয়ার তিরিশ বছর পরে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসবিদ হামিদ-উল্লাহ খানের আহাদিস-উল-খাওয়ানিন বা তারিখে চাটগাম প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের প্রাচীন বসতি, দালান-কোঠা ও দীঘি-পুকুরগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তারিখে চাটগামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলা সরকারের গণপূর্ত বিভাগ লিস্ট অব এইন্সন্্ মনুমেন্টস্ ইন দ্য চিটাগাং ডিভিশন প্রকাশ করে। এই তালিকায় নয়টি মসজিদ ও দুটি মন্দির নথিভুক্ত হয়। একই সময়ে (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে) গণপূর্ত দফতর থেকে আরেকটি তালিকা প্রকাশিত হয়, এ লিস্ট অব অবজেক্টস্ অব অ্যান্টিক্যুয়ারিয়ান ইন্টারেস্ট ইন দ্য লোয়ার প্রভিনসেজ অব বেঙ্গল। এ তালিকায়ও চট্টগ্রামের আটটি মসজিদ, একটি সমাধিসৌধ ও তিনটি মন্দিরের নাম উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর পরিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত প্রটেকটেড মন্যুমেন্ট অ্যান্ড মাউন্ডস্ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক তালিকায় বাঁশখালী থানার ইলসা (বখশি হামিদ মসজিদ) গ্রামে অবস্থিত একটি মোগল মসজিদ এবং হাটহাজারী থানার ফতেহ্পুর গ্রামের একটি সুলতানী শীলালিপিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে উল্লিখিত এবং ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিতালিকা থেকেই চট্টগ্রামে চারটি সুলতানী মসজিদ, চারটি মোগল মসজিদ একটি মোগল স্মৃতিসৌধ এবং তিনটি হিন্দু মন্দিরের কথা বারবার উঠে এসেছে। সরকারি তালিকার দুটি সুলতানী মসজিদের শীলালিপি এবং একটি মসজিদকে সংরক্ষণের উদোগ গ্রহণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐহিত্যর সাথে রাষ্ট্রীয় সরকারের বিমাতাসুলব আচরণের কারণে হাজার হাজার বছরের স্মৃতিজড়িত ১০টি মসজিদ, ৫টি বৌদ্ধ ধর্মীয় প্যাগোড়া, ৮টি হিন্দু ধর্মীয় প্রাচীনতম মন্দির, ৩টি প্রাচীন সেতু, ১১টি ঐতিহাসিক জমিদারের স্মৃতিজড়িত রাজবাড়ী, ১টি প্রাচীন ব্যাংকের নিদর্শন তেরজুরী সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। দুঃখের বিষয়, মোগল অধিকারের পর থেকে সাহিত্যে, ইতিহাসে এবং ভ্রমণবৃত্তান্তে নানাভাবে চট্টগ্রামের কোনো কোনো স্থাপত্যিক পুরাকীর্তির উল্লেখ বা বিবরণ পাওয়া গেলেও এসব নিদর্শন পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আমলে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত সরকারি বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়নি। কর্তৃপক্ষীয় অবহেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিম স্থাপত্যকীর্তিগুলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষিত না হওয়ায় সুলতানী এবং মোগল আমলের শীলালিপিযুক্ত মসজিদগুলোও ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং অবৈধ সংস্কারের কবলে পড়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রামের ইতিহাস।

সেই প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস কে বাঁচিয়ে রাখতে বারবার প্রধানমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীর বরাবরে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের জাতিয় জাদুঘর দিবস উপলক্ষে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক ৫ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে সোহেল মোঃ ফখরুদ-দীনের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘চট্টগ্রামকে আর কতকাল অবহেলার চোখে দেখতে হবে। হাজার-হাজার বছরের ঐতিহ্য মণ্ডিত চট্টগ্রাম পদে পদে বঞ্চনার ডাক। আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো ধ্বংস হতে চলেছে, সংরক্ষণ-সংস্কারের সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। চট্টগ্রামের প্রাচীন প্রত্ননিদর্শনগুলো জরুরিভাবে সংরক্ষণ করা খুবই দরকার।

দেশের ৬৪টি জেলার ঐতিহাসিক প্রত্নসম্পদ সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগের ব্যবস্থা হলে ও চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার এ-৫টি জেলাতে মাত্র ১টি মসজিদকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেটিও বর্তমানে প্রত্ন আইন অমান্য করে মসজিদের দরজা ও ফ্লোরে আধুনিক টাইলস লাগানো হলেও সরকারি ঐ সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারি সংরক্ষণ কৃত ঐ মসজিদ হলো বাঁশখালী উপজেলার ইলশা গ্রামের বকশী হামিদ মসজিদ। আমাদের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের প্রাচীন প্রত্ননিদর্শনগুলো সংরক্ষণ, নিয়ম মোতাবেক সংস্কার ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার প্রকাশ করতে পারলে চট্টগ্রামের গৌরব ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। যথা উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বহির্বিশ্বের পর্যটকের আগমন ঘটবে ফলে দেশের অর্থনীতি উন্নয়ন ও সম্ভব। উন্নত বিশ্বের প্রায় দেশে সে জাতি ও দেশের ঐতিহ্য রক্ষা ও সংরক্ষণ করে আসছে। আমাদের চট্টগ্রাম বারবার আজ অবহেলিত? নাকি সরকারের ঐ বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাফিলতি। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিচে উল্লিখিত প্রত্নসম্পদসমূহ পরিদর্শন করে তার আলোকচিত্র ধারণ করেছি। বর্তমান অবস্থায় সংরক্ষণ ও সংস্কার করা না হলে খুব অল্পসময়ে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবের অনেক প্রাচীন নিদর্শন। নিচে কিছু চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শনের নাম ও ঠিকানা সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেয়া হলো- ১) পরাতরী মন্দির, বৌদ্ধ শাসন আমলে নির্মিত, হাইদগাঁও পটিয়া, চট্টগ্রাম। ২) জৈনরাজার রাজবাড়ী, বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ৩) আধুখাঁর বাড়ি ও মসজিদ, দোহাজারী, চাগাচর, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ৪) তেরজুরী, প্রাচীন টাকার ব্যাংক ও আলী আকবর মসজিদ, আলমদরপাড়া, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৫) কুরাকাটানী মসজিদ বা লাকশা মসজিদ, পশ্চিম পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৬) হাবিলাসদ্বীপ প্রাচীন শত বর্ষীয় হিন্দুজোড় মন্দির, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৭) অর্দার বাড়ি, (ঐহিহাসিক জমিদার বাড়ি) তৈওরীহাট, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম। ৮) আধুখাঁর প্রাচীন মসজিদ, জঙ্গল পাহাড়, চুনতি, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম। ৯) বোমাংহাট জামে মসজিদ, বোমাং বাজার হাট, বাজালিয়া, চট্টগ্রাম। ১০) বিখ্যাত জমিদার যুগেশ বাবু রায় বাহাদুরের ঐতিহ্যম-িত রাজবাড়ী, আনোয়ারা চট্টগ্রাম। ১১) প্রসন্ন বাবুর রাজবাড়ীর তোরণ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১২) ঐতিহাসিক প্রাচীন মন্দির (নরসিমা মন্দির), ইতিহাসবিদ ড. সুনীতি কানুনগোর মতে এটি ভারত মহাদেশের সবচাইতে প্রাচীন মন্দির ইতিহাসবিদগণ কেউ কেউ এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় অতি প্রাচীন মন্দির বলে অভিমত প্রকাশ করেন, পরৈকোড়া, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৩) ঐতিহাসিক মনুমিয়া মসজিদ বাংলার লোকসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল মলকা বানু-মনু মিয়ার স্মৃতিজড়িত মসজিদ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৪) বিখ্যাত চাঁদ সওদাগরের দীঘি, হিন্দু ধর্মীয় আদি মনসার পুঁথিতে উল্লিখিত সেই দীঘি, দেয়াং পাহাড়, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৫) মোহছেন পীরের পাথর ও শীলালিপি, (মোহছেন আউলিয়া), মোহছেন পীর চট্টগ্রামের মুসলমান আগমনের ৩য় ব্যক্তি, তারই পাথর ভাসা সেই পাথর ও শীলালিপি আজও অবহেলিত পাঠোদ্ধার বিহীন অবস্থায় তার মাজারে আছে, আনোয়ারা, রুস্তমহাট, চট্টগ্রাম। ১৬) ছোরত বিবির মসজিদ ও দীঘি, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৭) বিখ্যাত ধর বাড়ি, রাউজান চট্টগ্রাম। ১৮) ইলিয়াছ খাঁর মসজিদ ও রাজবাড়ী, পশ্চিম পটিয়া, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম। ১৯) বুড়া গোসাই, বৌদ্ধধর্মীয় প্রাচীন মন্দির, ছনহরা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ২০) খান মসজিদ ও কদম রাসূল (সা.) ঐতি ঐতিহাসিক প্রাচীন মসজিদ ও নবী করিম (সা.)-এর পায়ে চিহ্নের ছাপ এখানে এনে স্থাপন করা হয়, বাগিচারহাট, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ২১) বদর পীরের প্রাচীন তোরণ, বদর পীরের সমাধি, বকশিরহাট, চট্টগ্রাম। ২২) কাতাল পীরের প্রাচীন দরগাহ, এটি চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাচীন স্থাপনা, বলা হয় বদর পীর, কাতাল পীর ও মোহছেন পীর এ তিনজনেই চট্টগ্রামের মুসলমান আগমনের প্রথম মিশনারি, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম। ২৩) নবাব ওয়ালিবেগ খাঁ মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম। ২৪) হামিদুল্লাহ খাঁ মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম। ২৫) বশির উল্লাহ খাঁ মসজিদ, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম। ২৬) আরকান সোসাইটি প্রাচীন মসজিদ, বহদ্দারহাট, চট্টগ্রাম। ২৭) প্রাচীন বুড়া মন্দির, মাস্টার দা সূর্যসেন পল্লী, রাউজান, চট্টগ্রাম। ২৮) পেলা গাজী মসজিদ ও দীঘি, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। ২৯) কাজী মসজিদ, ফটিকছড়ি, ৩০) হাসমত মিয়ার জল্লাত বাড়, ফাঁসিখানা, মসজিদ ও দীঘি, ভূজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। ৩১) সুলতানী আমলের ফকিরা মসজিদ (গায়েবী মসজিদ) হাটহাজারী সদর, হাটহাজারী। ৩২) সাহাবাড়ী, সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন জমিদার বাড়ি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। ৩৩) বিখ্যাত জমিদার নন্দী বাবুর বাড়ি, মন্দির ও দীঘি, নন্দীরহাট, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। ৩৪) শাহাজাহান আউলিয়ার দরগাহ ও তোরণ, সীতাকু-, চট্টগ্রাম। ৩৫) নয়দুয়ারা মসজিদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। ৩৬) সুলতানী আমলের হাম্মাদিয়া মসজিদ, মজ্জিদ্দা, সীতাকু-, চট্টগ্রাম। ৩৭) হাজার বছরের প্রাচীন বুড়া মন্দির, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম। ৩৮) কদম মোবারক মসজিদ ও কদম রসুল, মোমিন রোড়, চট্টগ্রাম। ৩৯) আন্দরকিল্লাহ্ শাহী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম। ৪০) হিন্দু ধর্মীয় সভ্যতার অতি প্রাচীন নিদর্শন সীতাকু-ের চন্দ্রনাথ মন্দির, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ফটিকছড়ির কাঞ্চননাথ মন্দির ও বোয়ালখালীর হিন্দু ধর্মীয় প্রথম দুর্গাপূজা স্মরণে কড়ল ডেংগা মেধশ মনির আশ্রমকে স্ব-স্ব অবস্থায় সংরক্ষণ ও হিন্দুদের জাতীয় তীর্থ ঘোষণা করা হোক। ৪১) হযরত বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, পাহাড়, মসজিদ ও পুকুর, বায়েজিদ চট্টগ্রামসহ চট্টগ্রামের অনেক পুণ্যভূমি এখন সংরক্ষণ করা হয়নি। হয়নি এখনও বিট্রিশযুদ্ধের জালালাবাদ সেই বিখ্যাত স্মৃতি সংরক্ষণ’ ৫ নভেম্বর ২০০৯, দৈনিক আজাদী।

স্থাপত্যিক পুরাকীর্তির প্রসঙ্গেই এসে পড়ে শীলালিপির কথা। মুসলিম স্থাপত্যের অলঙ্করণে লিপিকলার ব্যবহার স্বকীয় বৈশিস্ট্যে গরীয়ান। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে দু’ধরনের লেখার সন্ধান পাই। এক, ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি; দুই, ইতিহাসের তথ্য-উপাদান সমৃদ্ধ শীলালেখা। ইতিহাসের তথ্য-উপাদান সমৃদ্ধ পাঁচটি সুলতানী, চারটি মোগল এবং একখানি মোগলপরবর্তী শীলালিপি চট্টগ্রামে আবিষ্কৃত হয়। চট্টগ্রামের প্রথম স্থানান্তরযোগ্য পুরাকীর্তির সন্ধান দেন জন শোর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে। সেটি ছিল একটি গুহা থেকে পাওয়া রূপার ফলকে মগ-ভাষায় উৎকীর্ণলিপি। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ড পাহাড়ের অস্মীভূত কাঠের কয়েকখানা কৃপাণ আবিষ্কৃত হলে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রাগৈতিহাসিককালে গিয়ে পৌঁছে। অনুশীলনের ফলে দেখা যেতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম, প্রাচীন ত্রিপুরা এবং গারো পাহাড় ও তার ‘সন্নিহিত সুবিস্তৃত মধুপুর অরণ্যের ভূতত্ত্বীয় ইতিবৃত্ত সম্ভবত রচনা করেছে এক সুপ্রাচীন যুগের পটভূমি। টারসিয়ারি পর্বের বেলেপাথর এবং কাদাপাথর দিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা পাহাড়গুলো সৃষ্টি করেছে প্রাগৈতিহাসিক মানবজীবনের অনুকূল একটি নিজস্ব পরিবেশ। চট্টগ্রাম থেকে কোনো মন্দিরলিপি আবিষ্কৃত না হলেও এখানে পাওয়া গেছে চারটি তাম্রশাসন।

চট্টগাম থেকে আবিষ্কৃত হিন্দু ভাস্কর্যের বিবরণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে পটিয়ার ছনহরা গ্রামের জমিদার রাজচন্দ্র দত্তের বাড়ি থেকে পাওয়া যায় একটি দশভুজা ধাতু মূর্তি। এই ভাস্কর্যটি খুব প্রাচীন বলে মনে হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মিরসরাই থানার জোরারগঞ্জে পাওয়া যায় পিতলের তৈরি তিনটি ছোট ভাস্কর্য। এই সংগ্রহে সদাশিব, গণেশ এবং একটি দেবী মূর্তি ছিল। এই এলাকা থেকে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ সংগ্রহ করে একটি বেলে পাথরের ভাস্কর্য। এছাড়া এনায়েতবাজার বৌদ্ধ বিহারের স্টোরে কষ্টিপাথরে খোদিত কিছু হিন্দু ভাস্কর্য সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার এক গণ্ডগ্রাম ঝিয়রী-প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ইতিহাসে সারা উপমহাদেশে উজ্জ্বল হয়ে আছে এই নাম। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটনা। ঝিয়রী গ্রামের জনৈক শহরআলী বলীর ঘর তৈরির সময়ে মাটির নিচ থেকে বের হয় ৬১টি বুদ্ধ মূর্তি, মন্দিরের দুটি ক্ষুদ্র অনুকৃতি এবং মূর্তির ৩ খ- ভাঙা টুকরো। ঝিয়রীতে আবিষ্কৃত ধাতব ভাস্কর্যগুলো ছিল ৭ম-১১শ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে জনপ্রিয় মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন। এখনো কোনো কোনো সময় দেয়াং এলাকাসহ এ জেলার বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নানা প্রত্ন-উপাদান কেউ কেউ হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছেন এখনো। কিন্তু ঝিয়রীর ভাস্কর্যগুলো স্থানীয় বৌদ্ধ-শিল্পকলার চমকপ্রদ নিদর্শন হিসাবে আঞলিক উৎকর্ষের এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিল্পকলার প্রসারে যোগসূত্রে সাক্ষ্য রূপে অনন্য। এসব ভাস্কর্যের কোনো কোনোটিতে নালন্দা রীতির আবার কোনো কোনোটিতে বর্মী প্রভাব লক্ষণীয়।

ঝিয়রীর এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার উপমহাদেশীয় প্রাচীন শিল্পকলার মানচিত্রে চট্টগ্রামকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। বৌদ্ধ-শিল্পকলার একটি প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রামের স্থান প-িত মহলে স্বীকৃত হয়। ঝিয়রী-ভাস্কর্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও নান্দনিক রূপকলা শিল্প রসিকদের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাঙ্গুনিয়ার বেতাগি গ্রামসংলগ্ন কর্ণফুলি নদী থেকে কাঠ অনুসন্ধানকারীরা কালো পাথরেতৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করে। পদ্মাসনে ধ্যান-মুদ্রায় উপবিষ্ট এই বুদ্ধমূর্তি প্রাচীন শিল্পকলার এক অনন্য নিদর্শন, পালশৈলীর সঙ্গে যার সাদৃশ রয়েছে। এই ভাস্কর্যের কেন্দ্রীয় মূর্তিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে, এর শীর্ষে রয়েছে মন্দিরের প্রতিকৃতি। দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির অলকৃত থাম ধারণ করে আছে একটি নকশি তোরণ। সবকিছু মিলিয়ে একটি খোদিত গুহার আকার।

১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বড় উঠানের খিলপাড়া গ্রামে কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সপ্তম/অষ্টম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম এলাকা ‘হরিকেল’ নামে পরিচিত হতো। পরে পর্যায়ক্রমে বর্তমান নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং সিলেট এলাকাও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। হরিকেলের সমৃদ্ধির কথা অনুমান করা যায় তৎকালে এখানে প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থা পর্যালোচনার মাধ্যমে। এক পিঠে একটি ষাঁড় এবং অন্য পিঠে ত্রিধা চিহ্নখচিত এই মুদ্রা প্রাচীন হরিকেলের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। সময়ে সময়ে এই মুদ্রার ওজন-মানের তারতম্য থেকে বন্দর চট্টগ্রামের তৎকালীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উত্থান-পতনের ছক নির্ণয় করাও সম্ভব। প্রাচীন চট্টগ্রামের হাজার-হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও এই অঞ্চলের আদিকথা মালানিয়ে এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি।



No comments

Powered by Blogger.